সমস্ত লেখাগুলি

জলঙ্গী যেদিন ভোটের ইস্যু হবে -
অনুজ বিশ্বাস
Nov. 27, 2024 | পরিবেশ | views:900 | likes:0 | share: 0 | comments:0

জলঙ্গী নদী দিন দিন কোমায় চলে যাচ্ছে। নদিয়া মুর্শিদাবাদের অন্যতম এই জলঙ্গী একসময় গঙ্গা পদ্মা রিভার সিস্টেমের এক খরস্রোতা নদী হিসাবে লোকমুখে খোড়ে নামে পরিচিত হয়েছিল। আজ জলঙ্গী আই সি ইউ তে। না, কোনও প্রাকৃতিক কারনে নয়, আমাদের নিরন্তর উদাসীনতায়। নিম্ন গাঙ্গেয় অববাহিকায় বিগত দেড় দুই হাজার বছরে ভূমিরূপের বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি। ভূ গর্ভস্থ ভৌম জলস্তর মোটামুটি একই উচ্চতায় রয়েছে। এখনও তিন চারটে পাইপ পুঁতে নলকূপের জল যথেষ্ট পরিমানে পেতে কোনও অসুবিধা হয় না। মোটামুটি একহাজার বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত জলঙ্গী অববাহিকায় প্লেট টেকটোনিক এর প্রভাব পড়া প্রায় অসম্ভব, প্রভাব পড়লে বিশ্বের বৃহত্তম গাঙ্গেয় বদ্বীপের চরিত্র টাই বদলে যাবে। তাই কালের নিয়মে জলঙ্গী হারিয়ে যাচ্ছে এমন দাবি পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছু নয়।


গঙ্গা পদ্মা রিভার সিস্টেমের নদীয়া মুর্শিদাবাদ এবং পার্শ্ববর্তী যশোর ঝিনাইদহের কয়েক লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে জলঙ্গী ছাড়াও বাংলাদেশে থাকা ভৈরব, কপোতাক্ষ, রূপসা নদীর অবস্হা অপেক্ষাকৃত অনেক ভালো। অন্যদিকে জলঙ্গীর মত ভারতে থাকা চূর্ণী, ইছামতী নদী গুলোও আজ মরতে বসেছে। কপোতাক্ষ, রূপসার মত ছোট নদীকে জাতীয় জলপথে পরিনত করে বাংলাদেশ তাদের লাভজনক ট্রেড রুট বানিয়েছে। আর আমরা নদী বাঁচাও আন্দোলন করছি।


 আসল সমস্যার উৎপত্তি হয়েছে ফারাক্কা ব্যারেজ থেকে। ফারাক্কা ব্যারেজ তৈরী করে আমরা ভেবে নিয়েছি সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। বাংলাদেশকে জলচুক্তিতে হাফ ডজন গোল দেওয়ার আনন্দে আমাদের জামার কলার উপরে উঠেছে আর Sustainable Development করতে পারার আত্মতুষ্টিতে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বাঙালির অর্গ্যাজম হয়েছে। কিন্তু Development কে Sustain করতে যা যা করার দরকার সেগুলো আমরা না করে আমাদের দায় এড়িয়ে গিয়েছি। ফারাক্কা ব্যারেজের বাইপাস সার্জারি হিসাবে যে ফিডার ক্যানাল তৈরী হয়েছে তাতে জলঙ্গী নদীর কোনও লাভ হয়নি। জলঙ্গীর উৎসমুখ গোপালপুর ঘাট পলি পড়ে মজে গিয়েছে। আমরা ড্রেজিং করে পলি না সরিয়ে সেই জায়গায় চাষাবাদ করছি। প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার নদী খাত বেমালুম ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ গাছের গোড়া আমরা ইতিমধ্যেই কেটে ফেলেছি। তার উপর নদীর পাড়ে যথেচ্ছ পরিমাণে ঘরবাড়ী, অবৈধ ইটভাটা তৈরী হচ্ছে। নদীর পাড় বাঁধানো নেই। সেচ দপ্তর জেগে ঘুমাচ্ছে।


কৃষ্ণনগরে নতুন রেলব্রীজ তৈরি হয়েছে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হচ্ছে। খুব ভালো কথা। কিন্তু রেলব্রীজের বড় বড় পিলার গুলো নদীগর্ভে বসানোর ফলে যে পরিমাণ জায়গা দখল করেছে তার সম পরিমাণ জায়গা নদীর দুপাশে ড্রেজিং করে বাড়ানো হয়নি। উপরন্তু পাড়ের জমিতে বীজতালা করে চাষ হচ্ছে। এরফলে নদীখাতের আয়তন কমেছে, সমানুপাতিক হারে নদীর জলধারণ ক্ষমতাও কমেছে। কদমতলা ঘাটে শতাধিক বছর ধরে প্রতিমা বিসর্জনের ফলে নদী গর্ভে মাটি, কাঠামো প্রভৃতি জমা হচ্ছে। হালে বছর দশেক ধরে কৃষ্ণনগর পৌরসভার উদ্যোগে প্রতিমার কাঠামো তুলে পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করা হলেও, বিগত একশ বছর ধরে যে পরিমান অবক্ষেপ নদীতে জমা হয়েছে তার জন্য পর্যাপ্ত ড্রেজিং কখনই হয়নি। গোলাপটি এলাকায় নদী ক্রমশঃ সরু হয়ে আসছে। জলঙ্গীর শরীর অপুষ্টি গ্রাস করছে। জলঙ্গী নদীকে গলা টিপে মেরে ফেলার সমস্ত রকম ব্যবস্থা আমরা করে ফেলেছি।


জলঙ্গী নদীর শরীরে এখনও প্রাণ আছে বাংলাদেশের ভৈরব নদীর দয়ায়। ভৈরবের বিভিন্ন উৎস থেকে এখনও যেটুকু জল আসছে তাতেই জলঙ্গী অক্সিজেন পাচ্ছে। ফরাক্কা ব্যারেজ প্রকল্প থেকে বাংলাদেশ শিক্ষা নিয়েছে। পদ্মা দিয়ে যেটুকু জল তারা সারাবছর পেয়ে থাকে সেই জলের পরিপূর্ন ব্যবহার করেছে। তার সুফল হিসাবেই এখনও জলঙ্গী নদীর শরীরে রক্ত সংবহন তন্ত্রটি সচল রয়েছে। ভারত বাংলাদেশের মধ্যে 54 টি আন্তর্জাতিক নদী আছে যেখানে শুধু গঙ্গা ছাড়া অন্য কোনও নদীর ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সুষ্ঠু জলবন্টন চুক্তি নেই বলেই জলঙ্গী নদী এখনও বেঁচে আছে। ভৈরব আন্তর্জাতিক নদী। এর বিভিন্ন প্রবাহ কখনও ইছামতী, কখনও রায়মঙ্গল নামে প্রবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশ এখনও আন্তর্জাতিক মঞ্চে দুর্বল দেশ বলে আমাদের রক্ষে, নাহলে ফারাক্কা আর তিস্তার বঞ্চনার বিরুদ্ধে যেদিন দক্ষিন বঙ্গের ছোটো ছোটো আন্তর্জাতিক নদীগুলোর ক্ষেত্রে জলবণ্টন চুক্তি দাবি করে বসবে সেদিন আর কোনও ভাবেই জলঙ্গীকে বাঁচানো যাবে না।

এখনও সময় আছে, বিশল্যকরণী প্রয়োগ করতে পারলে কোমায় থাকা জলঙ্গী আবার বেঁচে উঠতে পারে। সবার প্রথমে পদ্মা থেকে জলঙ্গী নদীতে সরাসরি ফিডার ক্যানাল তৈরী করে নিরবিচ্ছিন্ন জল সরবরাহ সুনিশ্চিত করতে হবে। এরজন্য জলঙ্গী বাঁচাও আন্দোলনকে সামাজিক স্তর থেকে গণ আন্দোলনে রূপান্তরিত করতেই হবে। সেভ জলঙ্গী জাতীয় কর্মসূচী শুধুমাত্র কৃষ্ণনগরের এলিট শ্রেণীর লোকেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। জলঙ্গীর দুই পাড়ে বসবাসকারী লক্ষ লক্ষ সাধারন প্রান্তিক জনগণের মধ্যে এই আন্দোলনের প্রভাব শূন্য। এই বিরাট জনগোষ্ঠীকে আন্দোলন মুখী করা তখনই সম্ভব হবে যখন জলঙ্গীর দাবী সংসদীয় গণতন্ত্রের দাবী হিসাবে স্বীকৃত হবে। জলঙ্গীর দাবী, তথা জলের দাবী যেদিন ভোটের ইস্যু হবে সেদিন জলঙ্গী বাঁচবে, তার আগে নয়।


জলঙ্গী নদীর অববাহিকা আর কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্র প্রায় সমার্থক। জলঙ্গী একান্ত ভাবেই কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রের নিজস্ব নদী। তাই হাতে সময় বেশী নেই, মাত্র এক বছর। আগামী লোকসভা ভোটে দাবি উঠুক জলঙ্গী নদীকে কেন্দ্র করে। " হয় আমাদের জলঙ্গী নদী সারিয়ে দাও, নয়তো আমরা নোটায় ভোট দেবো" এই দাবীতে সোচ্চার হওয়া ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা খোলা নেই। রাস্তাঘাট, রেলপথ সারানোর দাবীতে তো অনেক ভোট হল, একবার নদী সারানোর দাবী নিয়েও আন্দোলন হোক। কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রের ভোটার প্রায় সাত লাখ। এরমধ্যে জলঙ্গী দুই পাড়ে বসবাস করেন এমন জনসংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। এর মধ্যে মাত্র একলাখ মানুষকে নদীর দাবীতে এক জায়গায় সংগঠিত করতে পারলেই সমস্ত রাজনৈতিক দলের রাতের ঘুম উড়ে যাবে,  জলঙ্গী তখন দিল্লীর পার্লামেন্টে আলোচনার বিষয়বস্তু হবে। শীর্ণ কায়া জলঙ্গী আবার পূর্ণ কায়া হবে। নাহলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে জলঙ্গীর অবস্হা বালুরঘাটের আত্রেয়ী নদীর মত হবে, জলঙ্গী নামের আগে চন্দ্রবিন্দু বসে যাবে।।


অনুজ বিশ্বাস,

(কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী, ভারতীয় ডাক বিভাগ)

কৃষ্ণনগর, নদীয়া।

কমিউনিস্ট পার্টি ও বিবর্তনবাদ -
অনুজ বিশ্বাস
Nov. 26, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:881 | likes:1 | share: 0 | comments:0

কলকাতায় হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে একটা খবর, চির রোমান্টিক বিপ্লবী আর্নেস্তো চে 'র মেয়ে অ্যালেইদা আসছেন আর তাঁকে গণ সম্বর্ধনা দেবে ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি। কেন? আর্নেস্তো চে গুয়েভারার মেয়ে বলে? কিন্তু তিনি তো বিপ্লবী নন, বিপ্লবী তথা সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী তো তাঁর বাবা। তাহলে অ্যালেইদাকে নিয়ে এতো নাচানাচি কেন? কমিউনিষ্ট পার্টি তো পরিবার তন্ত্রে বিশ্বাস করে না।


জন্মলগ্ন থেকে কমিউনিষ্ট পার্টি বিশ্বাস করে মানব বিবর্তনের প্রথমতত্ত্বে: শ্রেণী সংগ্রাম বা class struggle তথা ডারউইনের struggle for existence মন্ত্রে। স্বয়ং মার্ক্স চিঠি লিখে ডারউইনের কাছ থেকে এই 'শ্রেণী সংগ্রাম' শব্দটি ধার নিয়েছিলেন। এটা ছাড়া মানব সভ্যতার ইতিহাস অপূর্ণ থেকে যেত। এতদিন ধরে কমিউনিষ্ট পার্টি তার কথা রেখেছে, একনিষ্ঠ চিত্তে ডারউইনবাদ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। গরীব বড়োলোকের মধ্যে দিয়ে আন্ত:প্রজাতির সংগ্রাম, নিজের শ্রেণীর লোকেদের একত্রিত করানোর মধ্যে দিয়ে আন্ত:প্রজাতির সংগ্রাম আর রক্তমাংসের শরীর নিয়ে বেঁচে থাকতে চেয়ে প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করেছে।


অ্যালাইদার মধ্যে দিয়ে কমিউনিষ্ট পার্টি প্রবেশ করল বিবর্তনের দ্বিতীয় তত্ত্বে, ল্যামার্কের অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুশরন বা inheritance of the Acquired Characters মন্ত্রে। কমিউনিষ্ট পার্টির বর্তমান প্রজন্মের মনে হয়েছে অ্যালাইদা যেহেতু আর্নেস্তো চে গুয়েভারার মেয়ে তাই তার মধ্যে বাবার চির বিপ্লবী রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। বৈপ্লবিক চিন্তাধারা একটি অর্জিত বৈশিষ্ট্য যা অ্যালাইদা তার বাবার রক্তের মধ্যে দিয়ে পেয়েছেন। সমকালীন বিশ্বে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি আর্নেস্তো চে কে ডাক্তার থেকে রোমান্টিক বিপ্লবীতে পরিণত করেছিল। এক হাতে শত্রুর বিরুদ্ধে রাইফেল অন্য হাতে কমরেডের জন্য স্টেথোস্কোপ, শত্রুর সাইকোলজি বুঝে ফাঁদ পেতে অতর্কিত গেরিলা আক্রমণ পদ্ধতি আবিষ্কার করা আর্নেস্তো চে গুয়েভারার মেয়ের মধ্যেও যে তার বাবার বিদ্যুৎ প্রবাহিত হবে সে কথা একটা শিশুও বোঝে, কমিউনিষ্ট পার্টিও বোঝে। কিন্তু স্বীকার করতে কয়েক দশক সময় লাগিয়ে দিল। অ্যালাইদার মধ্যে দিয়ে সাম্যবাদের রঙ্গমঞ্চে পরিবারতন্ত্র নামক ভীমের গদাহস্ত প্রবেশ ঘটিল, থুড়ি স্বীকৃতি পাইল।


এখন বাকি থাকল হুগো দা ভ্রিসের মিউটেশন তত্ত্ব। এটা inter caste বা inter racial marriage ছাড়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ অন্যদল তথা অন্য মতাদর্শের লোকজনকে ভাঙিয়ে নিজেদের দলে নিয়ে এসে তাদের ক্রোমোজোমে মার্ক্সবাদ মিশিয়ে কোষ বিভাজন ঘটানো ছাড়া রাজনৈতিক মিউটেশন সম্ভব নয়। এখনও পর্যন্ত এমন সম্ভাবনা চোখে না পড়লেও ভবিষ্যতে কী হবে তার উত্তর একমাত্র সময় বলবে।

ভক্ত পদাবলী: নেহরু, চীন এবং রাষ্ট্রসঙ্ঘ -
অনুজ বিশ্বাস
Nov. 24, 2024 | রাজনীতি | views:279 | likes:0 | share: 0 | comments:0

গালওয়ান উপত্যকা এবং ডোকালাম অঞ্চলের সীমান্ত সমস্যা প্রসঙ্গে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে বলেছেন “ভারতকে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল আমেরিকা। জওহরলাল নেহেরু সেটি না নিয়ে চীনকে দিয়ে দেন। তাই আজ আমাদের এতো খারাপ অবস্থা।”

পোষ্ট ট্রুথ সময়কালে দাঁড়িয়ে আজকের বিজেপি নেতারা পেট গজিয়ে যা বলে সেটি “ইতিহাস” হয়ে যায়।  যেমন হঠাৎ একদিন সকালে বলে দিল যে “শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী পশ্চিমবঙ্গ তৈরি করেছিলেন”। অমনি সঙ্গে সঙ্গে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, দেশপ্রাণ বীরেন শাসমল, নেতাজি সুভাষ, ডঃ প্রফুল্ল ঘোষ, প্রফুল্ল সেন, অতুল্য ঘোষ, কিরণ শঙ্কর রায়, কালিপদ মুখার্জী, সতীশ দাশগুপ্ত, অজয় মুখার্জী, খগেন দাসগুপ্ত, লোকনাথ বল, সতীশ সামন্তদের মতো 10-15 বছর জেলে কাটানো সর্বত্যাগী “সন্ন্যাসী” স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আগে ট্রেন্ড করতে শুরু করে দিলেন “শ্যামা দা” .. যে শ্যামাদা ইউনিয়ন জ্যাক জড়িয়ে ধরে ঘুমোতেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকা কালীন ইউনিয়ন জ্যাক অমান্য করার অজুহাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বেত মারার হুকুম দিয়েছিলেন। এই শ্যামাদা 1941 সালে জিন্নার হাতে পায়ে ধরে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগ জোট সরকারের অর্থমন্ত্রী তথা ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার হয়েছিলেন (তখন রাজ্যের প্রধানকে প্রধানমন্ত্রী বলা হত)। বাংলা ভাগের পক্ষে শ্যামাদা ভোট দিয়েছিলেন মুসলিম লীগের সঙ্গে হাত মিলিয়ে। মনে বড়ো বাসনা ছিল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হবেন। কিন্তু যখন দেখলেন কংগ্রেস মন্ত্রীসভায় তার কোনো জায়গা হবে না, মুখ্যমন্ত্রী হবেন প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ, উপরন্ত জহরলাল নেহেরুর দয়ায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার প্রথম শিল্প মন্ত্রী হয়েই থাকতে হবে তখন দেশভাগকে হাতিয়ার করে বলে বসলেন, “অখন্ড ভারত”।

লে হালুয়া।.. এখন তো আর দেশ জোড়া লাগানো যাবে না... এখন যত পারি অখণ্ড ভারত বলে চিল্লা-চিল্লি করি। “... ভাঙো, ভাঙো, ভাঙো, ভাঙো। .. যেই ভেঙে গেলো, অমনি শ্যামাদা ডাক ছেড়ে বলে উঠলেন, “জোড়ো”... দেশীয় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থাকার জন্য, বিরোধিতা করার জন্য ওনাকে বিরোধিতা করতেই হবে। আর বিরোধিতা করতে গিয়ে শ্যামাদা এমন ভাবে রং বদলাবেন যে গিরগিটি অব্দি লজ্জা পাবে। যাই হোক, ১৯৫৩-তে dry pleurisy -তে শ্যামাদা পটল তোলার পরে 2019 সালে শ্যামাদা হঠাৎ বেঁচে উঠে এখন ঘোরাফেরা করছেন........“শ্যামা নামে লাগলো আগুন”।

এখন অমিত বাবু হঠাৎ বলছে যে, “ভারতকে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য করার প্রস্তাব চীনকে দিয়ে দিয়েছিলেন নেহেরু।“

1955 সালে 27 শে সেপ্টেম্বর সংসদে নেহেরু কি বলছেন?

“ভারতকে রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ার কোনো প্রস্তাব দেওয়া হয়নি... যারা রটিয়ে বেরাচ্ছে তারা ভুল রটিয়ে বেড়াচ্ছে। .. ভারতকে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হতে গেলে রাষ্ট্রসংঘের সনদ পরিবর্তন করতে হবে যে সনদের মাধ্যমে 1945 সালে স্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল। .. সে সনদ পরিবর্তন করা এখন সম্ভব নয়... ভারত নিজের জোরেই একদিন রাষ্ট্রসংঘের স্থায়ী সদস্যপদ লাভ করবে।“


তাহলে চীন ঢুকলো কি করে রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসাবে 1949 সালে?

উঃ চীন 1949 সালে ঢোকেনি... ঢুকেছে 1971 সালে। 

1971 সালের 15ই জুলাই, রাষ্ট্র সংঘের সাধারণ পরিষদের (General Assembly) 26 তম অধিবেশনে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের চীন সফর করে মাও জে দঙের সঙ্গে মিটমাট করে আসার পরে আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদতে আলবেনিয়ার নেতৃত্বে 17টি দেশ একযোগে  Restoration of the lawful rights of the People's Republic of China in the United Nations নামে একটি প্রস্তাব নিয়ে আসে, যেটা  The United Nations General Assembly Resolution 2758 (Resolution on Admitting Peking) নামেও পরিচিত। এই প্রস্তাব থেকেই যত সমস্যার উদ্ভব হয়। ঠাণ্ডা যুদ্ধে চীন কে পাশে পাওয়ার জন্য 25 অক্টোবর 1971 সালে 76-35 ভোটে এই প্রস্তাব চীনের পক্ষে পাস করানো হয় এবং রাষ্ট্র সংঘে চীনের অনুপ্রবেশ ঘটে। যদিও আমেরিকার উদ্দেশ্য সফল হয়নি। এই ঘটনার দুই মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধে  পাকিস্তানকে সাহায্য করতে গিয়েও রাশিয়ার ভয়ে চীন ব্যাক গিয়ার দেয় এবং মাদাগাস্কার প্রণালী থেকে ব্রিটিশ নৌবহর ল্যাজ গুটিয়ে পালায়। তথাপি ভিয়েতনাম যুদ্ধের ক্রমাগত ভয়াবহ পরিণাম, চীনের ভৌগোলিক অবস্থান এসব কারনে চীনকে যে কোনও মূল্যে পাশে পাওয়ার জন্য নিক্সন গিয়েছিলেন মাও এর সাথে সেটিং করতে।


সেকি? এ তো নতুন কথা। .. তাহলে 1949 থেকে 1971 পর্যন্ত কি হয়েছিল?

উঃ নাম নিয়ে বিবাদ। এই বিষয়টা একটু বিশদে জানা দরকার।

1912 সালের জানুয়ারি মাসে মাঞ্চু রাজবংশের পতন ঘটিয়ে সান ইয়াত সেনের নেতৃত্বে স্বাধীন ও সার্বভৌম Republic of China প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ 1912 থেকেই চীন একটি স্বাধীন দেশ। 1917 সালে ব্রিটেনের নেতৃত্বে চীন মিত্র বাহিনীর পক্ষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয় এবং ইংরেজদের স্বাভাবিক মিত্র (Natural Ally) হিসাবে কাজ করে। 1945 সালের 26 জুন রাষ্ট্র সংঘ প্রতিষ্ঠার সময় যে 51টি দেশ প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসাবে সনদে স্বাক্ষর করে তাদের মধ্যে অন্যতম এই Republic of China, আমাদের দেশেও ছিল কিন্তু স্বাধীন দেশ হিসাবে নয়, ব্রিটিশ ভারত হিসাবে আর চীন ছিল স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসাবে। কিন্তু যখন রাষ্ট্র সংঘের স্বপক্ষে অনুসমর্থন বা Deposit of Ratification দেওয়ার সময় আসে তখন তৎকালীন চিনা প্রেসিডেন্ট চিয়াং কাইসেক তা জমা দেন 28 সেপ্টেম্বর 1945 এবং ব্রিটিশ ভারতের প্রতিনিধি হিসাবে তৎকালীন বড়লাট লর্ড মেয়ো, যুদ্ধোত্তর দেশের পুনর্গঠনের অজুহাত দেখিয়ে Deposit of Ratification জমা করেন 30 অক্টোবর 1945.... স্বাভাবিক ভাবেই আন্তর্জাতিক মঞ্চে চীন ভারতের চেয়ে অনেক এগিয়ে যায়। 

রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য ১৯৪৫ সালে করা হয় Republic of China (ROC) কে, তখন সেই দেশের প্রধান ছিলেন চিয়াং কাই শেক এবং ওই ROC ছিল বর্তমান চীন ভূখণ্ডই। 1945 সালে যে পাঁচটি দেশ রাষ্ট্র সংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী এবং ভেটো ক্ষমতাধারী সদস্য (ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আমেরিকা, রাশিয়া এবং চীন) তারা প্রত্যেকেই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সনদ অনুযায়ী কোনও পরাধীন অথবা যুদ্ধপরাধী দেশ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী ভেটো প্রদানকারী সদস্য হতে পারে না। তাই জাপান, জার্মানীর মত দেশ যুদ্ধপরাধী বলে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সদস্যতা লাভ করে অনেক পরে। ভারত স্বাধীন হয়েছে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সৃষ্টির আরো 2 বছর পরে আর ততদিনে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে, রাষ্ট্রসঙ্ঘের সংবিধান সংশোধনের সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সে কারনেই, আজ অবধি ষষ্ঠ কোনও দেশ এই গ্রুপে ঢুকতে পারেনি। 


 ১৯৪৯ সালে মাও যে দঙের নেতৃত্বে চীনে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।  কমিউনিস্ট পার্টি চিয়াং কে পিটিয়ে তাইপেতে পাঠিয়ে দেয়, যেটির নতুন নাম হয় তাইওয়ান এবং সেই নতুন দ্বীপরাষ্ট্রের নাম হয়, Republic of China (RoC) ... আর মূল চীন ভূখণ্ডের নাম হয় Peoples Republic of China (PRC) ... মাও যে দঙের নেতৃত্বে। কিন্তু রাষ্ট্রসংঘের স্থায়ী সদস্য হিসাবে তো UN charter অনুযায়ী জ্বলজ্বল করছে ROC.. সেটা তাহলে এখন কারা? মূল ভূখণ্ড না তাইওয়ান? শ্যাম রাখি না কুল রাখি? চিয়াং কাই শেককে রাখি? না চীনের মূল ভূখন্ডকে রাখি?


এবারে এই দুটোর দেশের মধ্যে কোন দেশটি নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হবে? আমেরিকা, ফ্রান্স, ব্রিটেনের মতো পুঁজিবাদী রাষ্ট্র বলতে থাকে, তাইওয়ানই স্থায়ী সদস্য হওয়ার উপযুক্ত। কমিউনিস্ট রাশিয়া সমর্থন করতে থাকে চীনকে। 


দুটো দেশকেই কেন একসঙ্গে সদস্য করা যাচ্ছিলো না?

 ROC এবং PRC কেউ কারুর অস্তিত্ব মানছিল না এবং আজও মানে না... দুজনেই বলছিল তারাই মূল ভূখণ্ড এবং তাইওয়ানের শাসক। .. কিন্তু ধীরে ধীরে পশ্চিমী দেশগুলোও PRC কেই নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য মানতে শুরু করে যখন ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে চীন – সোভিয়েত সীমান্ত সংঘর্ষ শুরু হয়। আমেরিকা সেই সুযোগটা হাতছাড়া করেনি।  তাইওয়ানকে বিশেষ কিছু ব্যবসায়িক সুবিধা দিয়ে চীনের মূল ভূখণ্ডকেই নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য করা হয় সোভিয়েতকে কোনঠাসা করতে। এর পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে ঠান্ডা যুদ্ধ। যদি আমেরিকার সাথে ইউরোপের কোনও দেশের ঠান্ডা যুদ্ধ লাগতো তাহলে কেউ চীনের দিকে ফিরেও দেখতো না। কিন্তু সংঘর্ষ বাধলো রাশিয়ার সঙ্গে। এক্ষেত্রে চীনের ভৌগোলিক অবস্থান ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের শোচনীয় অবস্থা,  তার উপরে রাশিয়ার সঙ্গে চীনের সীমান্ত সংঘর্ষ। অর্থাৎ শত্রুর শত্রু মানে আমার বন্ধু। এই ফর্মুলা মেনেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের চীন সফর করে মাও জে দঙের সঙ্গে মিটমাট করে আসার পরে আমেরিকার ইশারায় আলবেনিয়ার নেতৃত্বে 17টি দেশ একযোগে  Restoration of the lawful rights of the People's Republic of China in the United Nations নামক প্রস্তাব উত্থাপন করে যা  The United Nations General Assembly Resolution 2758 (Resolution on Admitting Peking) নামেও পরিচিত। ভোটাভুটিতে পাশ হওয়ার পর রাষ্ট্রসঙ্ঘের পক্ষ থেকে সরকারী ভাবে জানানো হয়, "Recognising that the representatives of the Government of the People's Republic of China are the only lawful representatives of China to the United Nations and that the People's Republic of China is one of the five permanent members of the Security Council.

Decides to restore all its rights to the People's Republic of China and to recognise the Representatives as the only legitimate representative of China to the United Nations, and to expel forthwith the representatives of Chiang Kai-shek from its place..." 

1976th plennary meeting, dtd. 25 October 1971.

তাহলে নেহেরু আসছেন কোথা থেকে?

উঃ 1949 সালে নেহেরু নিজের মতামত দিয়েছিলেন যে দুই চীনের মধ্যে একজনকে যদি করতেই হয়, তাহলে পুঁচকে দ্বীপরাষ্ট্র তাইওয়ানকে না করে জনসংখ্যার কারণেই মূল চীন ভূখন্ডকেই অর্থাৎ PRC কেই নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য করা হোক। এটা সম্পুর্নভাবে নেহেরুর ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ।


কিন্তু আমেরিকা তো ভারতকে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য করার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল?

উঃ কোনো সরকারি প্রস্তাব আসেনি... কেনেডির মতো কেউ কেউ মনে করতেন যে গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে ভারতেরই রাষ্ট্রসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়া উচিত। .. কিন্তু সেক্ষেত্রে UN charter বা রাষ্ট্রসংঘের সনদ পরিবর্তন করতে হতো। আমেরিকা চাইলেই হতো না, সোভিয়েত ভেটো প্রয়োগ করে আটকে দিতে পারতো। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম আমেরিকার গায়ের জোরে ভারতকে স্থায়ী সদস্য হওয়ার আহ্বান জানালো, তাহলে তো রাষ্ট্রসঙ্ঘের নথিতে সেসব উল্লেখ থাকতো। এমন কোনও নথি রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাফেজখানায় পাওয়া যায় নি। যদি এমন কিছু ঘটতো তাহলে তার নথি অবশ্যই থাকতো। রাষ্ট্রসঙ্ঘ কোনো NDA সরকার নয়, যাদের সব কিছুতেই No Data Available থাকে।

তাহলে নেহরুর রাষ্ট্রসংঘের স্থায়ী সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করার তথ্যটি মিথ্যা?


উঃ ওই “শ্যামা দা”-র হঠাৎ করে মৃত্যুর 66 বছর পরে “পশ্চিমবঙ্গের রূপকার” হয়ে যাওয়ার মতো “সত্য “... “স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে গল্প “ করতে করতে শ্যামাদা হঠাৎ পশ্চিমবঙ্গকে কখন যে টেনে ভারতে নিয়ে এনে ফেললেন, অন্ধভক্তরা ছাড়া কেউ ধরতেই পারলো না। নেহরুর রাষ্ট্রসংঘের স্থায়ী সদস্যপদ চীনকে দিয়ে দেওয়ার গপ্পটিও অমন “শ্যামাদা”-র গপ্পের মতোই whatsapp university তে লেখা হয়েছে। কিভাবে লেখা হয়েছে সেকথা জানতে গেলে কিন্ত নিজের মগজাস্ত্রটি  গোয়াল ঘরে জমা রাখতে হবে।।

অনুজ বিশ্বাস, কৃষ্ণনগর, নদীয়া।

বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের ডাক বিভাগে কর্মরত।

উর্দু ভাষার ট্র্যাজেডি এবং হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ -
অনুজ বিশ্বাস
Nov. 23, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:877 | likes:0 | share: 0 | comments:0

এবিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই যে, উর্দু ভাষার জন্ম ও বিকাশ এই ভারতবর্ষের মাটিতেই হয়েছে। উর্দু আর হিন্দি ভাষা সংস্কৃতের যমজ উত্তরাধিকারী। ষোড়শ মহাজনপদের অন্যতম রাজ্য সুরসেন, তথা দিল্লী থেকে মথুরা পর্যন্ত যমুনার তীরবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতক থেকেই সাধারণ মানুষের মধ্যে সৌরসেনী প্রাকৃত অপভ্রংশের ব্যাপক প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। অনেকগুলি কথ্য ভাষার মধ্যে যেটি সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করে তা হল কৌরবী উপভাষা। এই কৌরবী উপভাষা থেকেই কালক্রমে উর্দু ও হিন্দি ভাষার জন্ম। দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়কালের মধ্যে সৌরসেনী কৌরবী প্রাকৃত এর সাথে হরিনাভী, অবধী, ব্রজবুলি, ভোজপুরি, বুলেন্দী এবং নবাগত আরবী, ফার্সি ও তুর্কী ভাষার সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয় হিন্দুস্তানী ভাষা। এটি একটি মিশ্র ভাষা, আর্য্যাবর্তের মিশ্র রাজনৈতিক ও নৃতাত্ত্বিক সঙ্করায়নের ফসল। হিন্দুস্তানী ভাষার নিজস্ব কোন সর্বজনগ্রাহ্য বর্ণমালা নেই, এটি একান্তভাবেই হিন্দুস্তানের কথ্য ভাষা, মধ্যযুগীয় উত্তর ভারতের নতুন সংস্কৃতি। 

হিন্দুস্তানী ভাষার প্রধান দুইটি লিখিত রূপ, একটি হল দেবনাগরী হরফে লিখিত হিন্দী এবং অপরটি নাসতালিক হরফে লিখিত উর্দু।

 হিন্দী আর উর্দু যমজ ভাষা, তাই এদের শব্দভাণ্ডারের অর্ধেক শব্দই এক ও সমার্থক।

              উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়কাল পর্যন্ত হিন্দুস্তানী সংস্কৃতি ভারতীয় সভ্যতায় সম্প্রীতির নিদর্শন হিসেবে গণ্য হলেও, সিপাহী বিদ্রোহের পরবর্তী সময়ে ইংরেজ সরকারের ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি চালু হওয়ার সাথে সাথে উর্দু ভাষার জীবনে দুর্দশা নেমে আসে। হিন্দু-মুসলিম আলাদা করার সাথে সাথে সরকার বাহাদুর খুব সুনিপুণ ভাবে দ্বি-জাতি ও দ্বি- ভাষা তত্ত্ব (Two Nations and Two Languages Theory) একত্রে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দেয়। ১৮৫৮ সালের মহারাণীর ঘোষণা পত্রের মধ্যে অবধারিত দেশভাগের সাথে সাথে উর্দু ভাষার মৃত্যু পরোয়ানাও যে লুকিয়ে আছে তা বোধ করি স্বয়ং মির্জা গালিবও সেদিন বুঝতে পারেননি। ব্রিটিশ সরকার সমাজের উচ্চস্তরে এজেন্ট নিয়োগ করে। হিন্দু ব্রাহ্মণ এবং উর্দুভাষী এলিট মুসলিম সমাজকে নিয়োগ করা হয় ভাষা পরিশোধনের কাজে। কুলীন ব্রাহ্মণদের হিন্দি ভাষার সংস্কৃতায়নের কাজে লাগিয়ে, হিন্দি ভাষায় তৎসম শব্দের ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে এটিকে কেবল হিন্দুদের ভাষা হিসাবে তুলে ধরা হয়। এ’থেকেই হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তান তত্ত্বের জন্ম এবং তার অনিবার্য ফলশ্রুতি আজকের হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ। অপরদিকে উর্দু ভাষাকে স্থানীয় প্রভাব থেকে মুক্ত করে ভাষার মধ্যে আরবী ও ফারসি শব্দ ভান্ডার ও বাকধারার প্রয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে এলিট মুসলিম সমাজকে ইংরেজরা যথেষ্ট তোল্লাই দেয়। সরকারী পৃষঠপোষকতায় সৈয়দ আহমেদ খানের নেতৃত্বে আলীগড় আন্দোলন ও পরবর্তীকালে খিলাফত আন্দোলন গড়ে ওঠে। 

উর্দু ভাষা শোধন করতে গিয়ে তার সমাধির পথ প্রশস্ত হয়।

 আরবী ও সংস্কৃত ভাষাকে খুড়োর কল বানিয়ে জাতিদাঙ্গা বাধিয়ে শুধু কোটি কোটি নিরপরাধ মানুষ খুন করাই নয়, এর সাথে হিন্দুস্তানী ভাষা ও সংস্কৃতিকেও খুন করেছে ইংরেজ সরকার, আর সেগুলোর সৎকার করে চলেছি আমরা, দেশের সাধারণ মানুষ।

            

  ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের সাফল্য বা ব্যর্থতা একটা জিনিস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, ভবিষ্যতে দেশভাগ অনিবার্য, নিদেনপক্ষে বাংলা আর আসাম প্রদেশের পুনর্বিভাজন অবধারিত। এরপরেই আসরে নেমে পড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি। 

একে একে গঠিত হয় মুসলীম লীগ ও হিন্দু মহাসভা। দুইদল হাতে হাত মিলিয়ে খাল কেটে কুমির আনতে বেশী সময় নেয়নি।

দুই জাতির সাথে দুই ভাষাও সম্মুখ সমরে নেমে পড়ে। হিন্দু মহাসভার সাথে যোগ দেয় সঙ্ঘ পরিবার। হিন্দু রাষ্ট্র ও জাতীয়তাবাদের আড়ালে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের ভিত্তি প্রস্তর হয়। মহাসভার নেতারা হিন্দি ভাষার প্রতি এতটাই মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েন যে তারা তাদের মাতৃভাষাকে অগ্রাহ্য করতে দ্বিধা বোধ করেন না। আশ্চর্যজনকভাবে হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তান তত্ত্বের যারা প্রবক্তা এবং ধারক ও বাহক, তাদের কারও মাতৃভাষা হিন্দী নয়। সাভারকরের মাতৃভাষা মারাঠী, মদনমোহন মালব্যের মালয়ী উপভাষা (ওনারা মধ্যভারতের মালয় অঞ্চলের আদি বাসিন্দা, মালয়- মালয়ী- মালভী- মালব্য)। লাজপত রাইয়ের মাতৃভাষা গুরুমুখী পাঞ্জাবি, তার বাবা ছিলেন উর্দুর শিক্ষক। 

এছাড়া শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বা ডা. হেডগেওয়ার কারও মাতৃভাষা হিন্দী নয়, যথাক্রমে বাংলা ও মারাঠী। শুধু হিন্দুত্বের স্বার্থে তারা হিন্দি ভাষার দালালী করেছেন।

 উল্টোদিকে পাকিস্তানের ধ্বজাধারী মুসলীম লীগ উর্দু ভাষাকে হাতিয়ার করে দুর্বার গতিতে এগোতে থাকে। এখানেও অদ্ভুত সমাপতন। মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের কারও মাতৃভাষা উর্দু নয়। জিন্নার মাতৃভাষা গুজরাটি আর তৃতীয় আগা খানের পারসি। রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার নামে মাতৃভাষার এমন নির্লজ্জ বলিদান ভারতবর্ষ আগে কখনও দেখেনি। স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি যেন তেন প্রকারে আমাদের উপর হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে। আমরা মানে ভারতবর্ষের সেই সত্তর ভাগ, প্রায় আশি কোটি মানুষ যাদের মাতৃভাষা হিন্দি নয়। চল্লিশ কোটি মানুষের দায়ভার চাপিয়ে দেওয়া হল আশি কোটি মানুষের উপর। বর্তমানে শুধু চাপিয়ে দেওয়াই নয়, নাগপুরের গোপন এজেন্ডা অনুযায়ী একদেশ একজাতি একভাষা নীতি কার্যকরী করার জন্য হিন্দী বাধ্যতামূলক করতে চায় দিল্লির সরকার। ২৬/১১ পরবর্তী সময়ে ইসলামোফোবিয়ায় ভুগতে থাকা ভারতে উর্দু ভাষার গায়ে সুনিপুন ভাবে সন্ত্রাসবাদী দেশদ্রোহীর তকমা এঁটে দেওয়া হয়েছে। শাহীনবাগ আন্দোলনের পর উর্দু ভাষা আর টুকরো টুকরো গ্যাং সমার্থক বলে পার্লামেন্টে আওয়াজ তুলেছেন আমাদের মন্ত্রীবর। এরসাথে ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টা জারি আছে। হিন্দি ভাষার ধ্বজাধারীরা ভুলে গেছে স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলা সাহিত্যের যা ভূমিকা, উর্দু কবিতা আর শায়ারীর ভূমিকা তারচেয়ে কোনও অংশে কম নয়। এমনকি যে ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান ব্রিটিশের মেরুদণ্ডে কম্পন ধরিয়ে দেয় সেটির উদ্গাতা ছিলেন উর্দু কবি মওলানা হাসরত মোহানি। এখানেও লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, বর্তমান ভারতে যে দুইজন মানুষ হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের পোস্টার বয়, তাদের কারও মাতৃভাষা হিন্দী নয়, তারা দুজনেই গুজরাটি বানিয়া।

      ভারতে মত পাকিস্তানেও উর্দু ভাষার অবস্থা শোচনীয়। ১৯৪৮ সালে উর্দু ভাষাকে সেদেশের জাতীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়ার সাথে সাথে দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়। দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১০% উর্দুভাষী, আর সেই ভাষাকেই দেশের জাতীয় ভাষা হিসাবে চাপিয়ে দেওয়া হল। উর্দু কোনোভাবেই পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হতে পারে না, এটি ছিল মুসলীম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনের একটা হাতিয়ার মাত্র। পাকিস্তানের পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, খাইবার প্রদেশ এবং সমগ্র পূর্ব বাংলা জুড়ে উর্দু ভাষার লেশ মাত্র নেই। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের ৩০% মানুষ ছিল বাঙালী। বাকি ৬০% দখল করে আছে পাঞ্জাবি, পোস্তু, সিন্ধি এবং মুলতানি। পাকিস্তানে উর্দুভাষী মানুষের তুলনায় ভারতে উর্দুভাষী মানুষের সংখ্যা অন্তত তিনগুণ বেশি। বর্তমানে সেদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ পাঞ্জাবি ভাষায় কথা বলেন। পাকিস্তানের মানুষ উর্দু ভাষাকে আজও হিন্দুস্তানের ভাষা মনে করে, তেমনি ভারতের কাছে পাকিস্তানি জঙ্গীদের ভাষা হল উর্দূ। ১৯৪৮ সালে বাঙলা ভাষা কে কেন্দ্র করে যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের সূচনা হয় তা সারা বিশ্বে ভাষা আন্দোলনের বিগ্রহ নড়িয়ে দেয়। বাঙলা আর উর্দু ভাষার সংঘাত চরমে ওঠে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি। রক্ত দিয়ে রচিত হয় মাতৃভাষার বিজয়গাথা এবং বাঙালির আন্তর্জাতিক পরিচয় যার অনিবার্য পরিণতি হল ১৯৭১ সালের স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। রাজনৈতিক মেরুকরণের খেলায় ধর্ম যদি তুরুপের তাস হয় তবে ভাষা হল ইস্কাবনের টেক্কা যাকে ধর্ম দিয়েও ওভার ট্রাম্প করা যায় না। তাই মহম্মদ আলি জিন্না, যিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে তিনি উর্দু ভাষা ও নাসতালিক বর্ণমালার বিন্দু বিসর্গও জানেন না এবং লাল লাজপতরাই দেবনাগরী বর্ণমালা ও হিন্দী ভাষা সম্পর্কে বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন না করেও শুধু নিজেদের বিচ্ছিন্নতাবাদী ধর্মীয় রাজনৈতিক কায়েমী স্বার্থ চরিতার্থ করতে উর্দু আর হিন্দি ভাষার হয়ে ওকালতি শুরু করেন।

একথা অস্বীকার করার কোন জায়গা নেই যে, সরকারী মদতে যেমন কোনও ভাষার বৃদ্ধি ও বিকাশ সম্ভব নয়, তেমনি রাষ্ট্রের চরম বিরোধীতা সত্ত্বেও কোনও ভাষা হারিয়ে যায়নি।

 পাকিস্তানে উর্দু ভাষার একচ্ছত্র আধিপত্য করার মত ফাঁকা মাঠ থাকলেও আজ অবধি সমস্ত রকম সরকারী বদান্যতা সত্ত্বেও সেদেশে উর্দু ভাষার দুরবস্থা বেড়েছে বৈ কমেনি। আজ অবধি দ্বিতীয় কোনও গালিব, প্রেমচাঁদ, ইকবাল বা মন্টো কেউ উঠে আসেনি। 

তেমনি ভারতের মাটিতে বিশুদ্ধ হিন্দী ভাষা ক্রমশ লুপ্তপ্রায়। পরিবর্তে হিন্দী আর ইংরেজি ভাষার অবৈধ সহবাসের ফলে হিংলিশ নামক এক বর্ণসঙ্কর খিচুড়ি ভাষার সৃষ্টি হয়েছে।

 রাষ্ট্রশক্তি যখন কোনও ভাষার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করে তখন সমাজ নিজ দায়িত্বে সেই ঐতিহ্য বয়ে নিয়ে চলে। ১৯৪৮ সালে জিন্না পূর্ব বাংলায় উর্দু ভাষা প্রতিষ্ঠা করার নিদান দেন, যার ফলশ্রুতি হিসাবে পরবর্তী দুই দশকের মধ্যে গোটা পূর্ব পাকিস্তান লাহোরের হাতছাড়া হয়ে যায়। পারস্য দেশে ইসলামী শাসন চালু হওয়ার পর লাগাতার চারশত বছর ধরে আরব খলিফারা বুলডোজার চালিয়েও ইরানে আরবী ভাষায় প্রচলন ঘটাতে পারেনি। ইরানীরা আরবী ভাষায় কোরআন পাঠ করতে সম্মত হলেও দৈনন্দিন জীবনে এবং ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে পারসি ভাষা ছাড়া এক চুলও নড়েনি, নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে তারা কোনও আপোস করেনি। এটি বিশ্বের ইতিহাসে দীর্ঘতম সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের অন্যতম উদাহরণ। বর্তমান ইরাকের কুর্দ জনজাতি হাজার অত্যাচার সহ্য করেও কুর্দিশ ভাষা ছাড়েনি, এমনকি স্বয়ং সাদ্দাম হোসেন কয়েক লক্ষ কুর্দ জনজাতি হত্যা করেও তাদের মধ্যে আরবী ভাষার প্রচলন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে।

      ১৯৪৮ সালে জিন্না পূর্ব পাকিস্তানে গিয়ে একদেশ একভাষা নীতির পক্ষে সওয়াল করেন, যার মারাত্মক ফলাফল প্রত্যক্ষ করে পাকিস্তান আর কখনও ভাষা নিয়ে মাতব্বরি দেখানোর সাহস পায়নি। 

ভাষা আন্দোলনের সামনে পাকিস্তান চরম শিক্ষা লাভ করলেও, ভারতবর্ষ এথেকে কোনও শিক্ষা নেয়নি।


সাংবিধানিক ভাবে ভারতের জাতীয় ভাষা না হওয়া সত্ত্বেও, সংবিধানের ৩৪৩ ধারায় হিন্দি আর ইংরেজি ভাষাকে একত্রে শুধুমাত্র সরকারী কাজ চালানোর ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরেও, হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে দ্রাবিড়ভূমে প্রথম গণ আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। তামিলনাড়ু, অন্ধ্র প্রদেশ ভাষা আন্দোলনে নতুন দিশা দেখিয়েছে। দিল্লীর হিন্দি শাসক পরাজয় স্বীকার করে ফিরে গেছে। ভারতবর্ষ বহুত্ববাদে বিশ্বাসী, নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের দেশ। এখানে একদেশ একভাষা নীতি কখনই চলতে পারে না। 

বারংবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও দিল্লির শাসক এই সহজ সত্যটিকে অস্বীকার করে এসেছে। হিন্দী কখনই ভারতের জাতীয় ভাষা হয়ে উঠতে পারে না।

 সমগ্র দাক্ষিণাত্য ও উত্তরপূর্বে হিন্দী চলেনা। ভারতে প্রচলিত ২২৫টি দেশীয় ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষা হিসাবে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক, অন্তত পঁচাত্তর কোটি মানুষ আজকের দিনে কমবেশি ইংরেজী জানেন। অর্থাৎ, অভিন্ন ন্যুনতম জ্ঞান বা Common Minimum Knowledge এর সূচকে মাপলে ভারতের সবচেয়ে বেশি মানুষ যে ভাষা জানেন সেটি হল ইংরেজি। একমাত্র ইংরেজি হওয়া উচিত ভারতের Lingua Franca, কিন্তু তা হওয়ার নয়। আর্য্যাবর্ত, পশ্চিম ভারত জয় করে হিন্দি ধ্বজাধারী দের চোখ পড়ল বাংলার দিকে। বছরের পর বছর ধরে পরিকল্পনা করে, গোবলয় থেকে হাজারে হাজারে হিন্দিভাষী মানুষকে বাঙলায় নিতে এসে, হিন্দু মুসলিমে আড়াআড়ি বিভাজন ঘটিয়ে, উত্তর প্রদেশ মডেলের সোনার পাথরবাটি দেখিয়েও হিন্দী বর্গীর দল বঙ্গদূর্গের দরজা খুলতে পারলো না। বাংলার মানুষ রাজনৈতিক ভাবে হিন্দী অসুরের আক্রমণ ঠেকিয়ে দিল। এরাজ্যের মানুষ জানে মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতা কতখানি। বাঙালী মাতৃশক্তির পূজারী, পুরুষতান্ত্রিক অবতার তত্ত্বের পরোয়া করে না। বাঙলার কৃষ্টি সংস্কৃতি আক্রান্ত হলে রাম-আল্লাহ-যীশু কেউ বাঁচাতে আসবে না, বাঙালী নিজেই নিজেদের বাঁচাবে। হিন্দী আগ্রাসন গণতান্ত্রিক ভাবে প্রতিহত হয়েছে, এখন সময় হিন্দি ভাইরাস আর ইউপি মডেল থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার। বাংলার মানুষ একদিন বিলাতী পণ্য বয়কট করেছে, এবারে হিন্দী প্রলোভন বয়কট করবে।।


অনুজ বিশ্বাস, কৃষ্ণনগর, নদীয়া।

বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের ডাক বিভাগে কর্মরত।

ভারতের মিসিং উইমেন -
অনুজ বিশ্বাস
Nov. 21, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:614 | likes:0 | share: 0 | comments:0

প্রাচীন ভারতে নদীমাতৃক-মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার হাত ধরে সভ্যতার যাত্রা শুরু হয়। প্রাক বৈদিক যুগ থেকেই মাতৃতান্ত্রিক সমাজে নারী সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করলেও পরবর্তীতে পেশীশক্তির দ্বারা রচিত "বীর ভোগ্যা বসুন্ধরা" মতবাদ এর হাত ধরে ক্ষমতা হস্তান্তরের পালা শুরু হয়। এরপর এল মনুসংহিতা, মাতৃতন্ত্রের সর্বনাশ হয়ে গেল, মাতৃজাতি বারবনিতায় পরিণত হল। বর্তমান যুগে শিক্ষিত উন্নত দেশগুলোতে দেখা যায় নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে সামান্য বেশি। আধুনিক মানুষ তথা হোমো-স্যাপিয়েন্স এর মধ্যে টিকে থাকার ক্ষমতা বা Survival Ability সাধারনত মহিলাদের বেশি, তাই মহিলাদের গড় আয়ুও পুরুষের চেয়ে বেশি হয়। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় নারী ও পুরুষের অনুপাত প্রায় সমান সমান হলেও পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে একাধিক বিশ্বযুদ্ধ ও অন্যান্য রাজনৈতিক গোলযোগের কারণে বহু কোটি মানুষের মৃত্যু হয় যার অধিকাংশই ছিলেন পুরুষ। রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠার পর সারা বিশ্বের সামগ্রিক জনসংখ্যা বিচার করলে দেখা যায় নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে বেশি। ১৯৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে নারী পুরুষের অনুপাত ছিল প্রায় ১ : ০.৯৪৫, অর্থাৎ প্রতি ১০০০ জন মহিলা প্রতি পুরুষের সংখ্যা ৯৪৫ জন প্রায়।

এই অব্দি সবকিছু দিব্যি ঠিকঠাক ছিল। গন্ডগোল বাঁধলো গত শতকের আশির দশকে। একজন দেশদ্রোহী, দেশত্যাগী বাঙালী গবেষক লক্ষ্য করলেন এক আশ্চর্য জিনিস....ভারতের মেয়েরা কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। দেশের বহু রাজ্যে মেয়েদের সংখ্যা শোচনীয় ভাবে কমতে শুরু করেছে। সবচেয়ে উপদ্রুত রাজ্য গুলি হল বিহার, উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, গুজরাত, মহারাষ্ট্র ও মধ্য প্রদেশ; তথাকথিত “আর্য্যাবর্ত”। সাবিত্রী সীতার দেশ থেকে মেয়েদের হরণ করছে কোনও এক অজানা রাক্ষসের দল। আরও গবেষণায় দেখা গেল এটা শুধু ভারতের ছবি নয়, চীন -মধ্যপ্রাচ্য -উত্তর আফ্রিকা- দক্ষিণ এশিয়া সর্বত্র এক চিত্র। দেখাগেল সারা পৃথিবীতে যা থাকা উচিৎ তার চেয়ে ১০কোটি মহিলা কম, যার মধ্যে শুধু ভারতেই সংখ্যাটা প্রায় ৪ কোটির কাছাকাছি। এরাই Missing Women..কোথায় গেলেন তাঁরা? হঠাৎ করে উবে গেল এতগুলো মানুষ? কিন্তু কিভাবে?

গবেষণায় বেরিয়ে এল এক ভয়াবহ, গা ঘিনঘিন করা জান্তব সত্য....আল্ট্রাসনোগ্রাফি বা আল্ট্রাসাউন্ড। আল্ট্রা সাউন্ড করে খুঁজে বার করা হচ্ছে কন্যাভ্রূণ এবং শুধু মেয়ে হওয়ার অপরাধে তাদের মাতৃগর্ভেই খুন করা হচ্ছে। সারাবিশ্বে হুলুস্থুল পড়ে গেল। কারণটা নীচের পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট –

রাষ্ট্রপুঞ্জের World Population Prospectus ২০১৯ অনুসারে বর্তমান ভারতে প্রতি ১০০০ জন পুরুষে নারীর সংখ্যা মাত্র ৯৪৩ জন। ১৯০১ সালে ব্রিটিশ ভারতে ১০০০ জন পুরুষে নারীর সংখ্যা ছিল এযাবৎ কালের মধ্যে সর্বোচ্চ, ৯৭২ জন। এরপর সংখ্যাটা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। ১৯১১ সালে ৯৬৪; ১৯২১ সালে ৯৫৫; ১৯৩১ সালে ৯৫০ হয়ে ১৯৮১ সালে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৯২৭ জন, যা ইতিহাসে সর্বনিম্ন। ১৯৬৫ সাল নাগাদ ভারতে বাণিজ্যিক ভাবে আল্ট্রাসাউন্ড এর ব্যবহার শুরু হয়। তারপর থেকেই লক্ষ্যণীয় ভাবে মেয়েদের সংখ্যার কমতে থাকে। ১৯৮৫-৯০ সালের মধ্যে অবস্থা চরমে ওঠে।

দেশব্যাপী ছড়াতে থাকা এই সামাজিক ক্যান্সার দেশের একশো কোটি মানুষের চোখ এড়িয়ে গেলেও সেই দেশত্যাগী বাঙালী গবেষকের চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না। যদিও বাঙালী গবেষক তখন দেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে হার্ভার্ডের ল্যামন্ট ইউনিভার্সিটিতে অর্থশাস্ত্রের অধ্যাপনা করেছেন। সব দেখেশুনে তিনি আর থাকতে পারলেন না। কিন্তু তিনি তাঁর দেশের মানুষকে ভালো করেই চেনেন। তিনি জানেন, এই পোড়া দেশে কেউ তাঁর কথা গ্রাহ্য করবেনা। তাই যেখানে বললে কাজ হতে পারে সেখানেই তিনি কলম ধরলেন। এই বাঙালী অর্থনীতিবিদ প্রথমে নিউ ইয়র্কের বুক রিভিউ তে এ’বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লেখেন, যা পরবর্তীকালে British Medical Journal (Vol. 304, Issue 6827 dtd 7th March, 1992, Pp 587-588) এ একটা বিস্ফোরক গবেষণাপত্র হিসাবে বেরোয় "Missing Women: Social Inequality Outweighs Women's Survival Advantage in Asia and North Africa" নামে। 

সারা বিশ্বে আলোড়ন পড়ে যায়। রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে চলতে থাকা এক সুপরিকল্পিত নারকীয় গনহত্যার নৃশংস কাহিনী বে-আব্রু হয়ে পড়ে।

 দেশে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়। ভারত সরকার বাধ্য হয় ব্যবস্থা নিতে। ১৯৯৪ সালে জারি হয় Pre-Conception and Pre-Natal Diagnostic Techniques (PCPNDT) Act বা Prohibition of Sex Selection আইন। এর ফলে গর্ভস্থ ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য করা হয় এবং দেশের সমস্ত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গর্ভস্থ ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ বন্ধ করার নোটিশ টাঙানো বাধ্যতমূলক করা হয়।

যদিও এই আইন প্রণয়নের ফলে লাভের লাভ আজও বিশেষ হয়নি তবুও যেটুকু হয়েছে তাই বা কম কি? আজ ভারত তথা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে মানুষের লিঙ্গ অনুপাত আগের তুলনায় অনেক ভালো। জন্মের আগে লিঙ্গ নির্ধারণ অপরাধ ঘোষিত হয়েছে। কোটি কোটি মেয়ের প্রাণ বাঁচিয়েছেন এই যুগন্ধর বাঙালী, যাঁর নাম অমর্ত্য সেন। জন্ম জন্মান্তরের জন্য ভারতবর্ষ তাঁর কাছে চির ঋণী হয়ে থাকবে।

আমরা এই সর্বভারতীয় লজ্জার কথা জানি না, আর জানলেও তাকে কর্পোরেট আর গণতন্ত্রের কার্পেট দিয়ে ঢেকে রাখতে সদা সচেষ্ট থাকি। উত্তর ভারতীয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে গেঁথে যাওয়া মনুবাদী সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় কলঙ্ক এই কন্যা ভ্রূণ হত্যা। এরা মৃণ্ময়ী রূপে আদ্যাশক্তির আরাধনা করে আর গর্ভের দুর্গাকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ দেয়না। এমনকি দেশের সরকারও ভ্রূণ হত্যাকে পরোক্ষ সমর্থন জানিয়ে নিজের মত ন্যারেটিভ তৈরি করে। ২০১৬ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী শ্রীমতী মানেকা গান্ধী গর্ভস্থ সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ বাধ্যতমূলক করার পক্ষে সওয়াল করেন। ২০১৬ সালের ফেব্রয়ারি মাসে All India Regional Editors' Conference এ তিনি বলেন ".... the women should be compulsorily told that whether it is a boy or a girl child whom she is going to give birth"... প্রথম বিশ্বের দেশগুলোতে এমন প্রস্তাব লোভনীয় কিন্তু ভারতের জন্য কখনোই নয়। অন্তঃস্বত্তা মহিলা নাহয় জানলেন তাঁর গর্ভস্থ ভ্রূণ ছেলে না মেয়ে, কিন্তু যদি মেয়ে হয় তখন সেই মেয়েটিকে সমাজের হায়েনা দের হাত থেকে কিভাবে রক্ষা করা হবে সেবিষয়ে মন্ত্রী মহোদয়া একটি কথাও খরচ করলেন না। তিনি সুকৌশলে এড়িয়ে গেলেন আমাদের আজন্ম লালিত মনুবাদী মানসিকতা। পুত্র সন্তানের লোভে আমরা মাতোয়ারা হতে গিয়ে আমাদের মনে এমন এক কদর্য আত্মশ্লাঘা তৈরী হয়েছে যে নিজের অজান্তেই আমরা সৃষ্টির পথ বন্ধ করতে উদ্যত হয়েছি। আর্য্যাবর্তের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। এখানে মেয়েরা সামাজিক ব্যবসার পণ্য। উত্তর ভারতীয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের বৌদ্ধিক মানদণ্ডের কোন জায়গা নেই, অর্থই শেষ কথা বলে।

স্বাধীনতার পরে মনুবাদী চিন্তাধারা কে প্রসারিত করার দায়িত্ব নেয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। সঙ্ঘের প্রাণপুরুষ গুরু গোলবলকার তাঁর Bunch of Thoughts বইতে ভারতীয় নারীর আধুনিক প্রগতিশীল চিন্তাধারা কে নস্যাৎ করে, সংস্কারের দোহাই দিয়ে তাদের পরিষ্কার ভাবে পুরুষের ভোগ্যপণ্য হিসাবে উপস্থাপন করে ব্রাহ্মণ্যবাদী দের জন্য সমাজের সর্বস্তরের নারীর গর্ভে সন্তান উৎপাদন এক পবিত্র কর্তব্য বলে উল্লেখ করেন। তিনি মনে করেন উত্তর ভারতীয় উন্নত ব্রাহ্মণের ঔরসে দক্ষিণ ভারতীয়, তথাকথিত নিম্ন বর্ণের মহিলার গর্ভে যে সঙ্কর প্রজাতির সন্তান জন্ম নেবে তার মাধ্যমেই নিম্ন বর্ণের জিনগত উন্নতি সম্ভব। এর ফলে নিম্নবর্গের মানুষের মধ্যে কন্যাভীতি তৈরি হয়। উচ্চবর্ণের লম্পটদের লোলুপ দৃষ্টি থেকে নিজের মেয়েকে রক্ষা করতে পারার অপারগতা থেকেই সমাজের নিম্নবর্ণের মধ্যেও কন্যা ভ্রূণ হত্যা করার প্রবণতা তৈরি হয়। অন্যদিকে মনুসংহিতা অনুসারে উচ্চবর্ণের বিবাহে পণ দেওয়া আবশ্যিক। এখানেও কন্যাসন্তান ক্রমশ পিতার বোঝা হয়ে ওঠে। এপ্রসঙ্গে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ওয়াই.কে. সভারওয়াল মন্তব্য করেন, "Investing in a daughter, They say, is like 'watering your neighbour's lawn' "... আর্য্যাবর্তের মানুষ ভাবে “পুরুষ হল উৎপাদক, মহিলা হল উপভোক্তা”। এমন মধ্যযুগীয় মানসিকতা আজও আমাদের জাতীয় লজ্জা।

আজ উঠতে বসতে অমর্ত্য সেন কে গালিগালাজ করা, তাঁকে দেশদ্রোহী, শহুরে নকশাল বলাটা আমাদের নতুন রাজনৈতিক প্রোপাগন্ডা। উনি নোবেল পেয়েছেন বটে, কিন্তু 'ভারতের জন্য কী করেছেন?' এই প্রশ্নে একজন নতুন ভোটারও নিজের ফেসবুক ওয়াল ভরিয়ে ফেলে। সেদিন অমর্ত্য সেন ওই প্রবন্ধ না লিখলে আজকের অনেক অষ্টাদশী যুবতী হয়তো পৃথিবীর আলোই দেখতে পেত না। যে মানুষের ঋণ সারা বিশ্ব জন্ম জন্মান্তরেও শোধ করতে পারবে না সেই মানুষের যোগ্যতা নিয়ে আজকের হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির অশিক্ষিত গ্র্যাজুয়েটরা প্রশ্ন করে, অনেকাংশেই রাষ্ট্রীয় মদতে। এ কেবল ভারতবর্ষেই সম্ভব।।

তথ্যসূত্র:

১. অমর্ত্য সেনের মূল প্রবন্ধের ওয়েবলিঙ্ক: https://www.bmj.com/content/304/6827/587

২. MS Golwalkar, Bunch of Thoughts, Ch. Call to the Motherhood, Pp. 283-287., The Organizer, January 2, 1961, Pp. 5, 16.

৩. অন্যান্য সকল তথ্য ও পরিসংখ্যান ইন্টারনেটে সহজলভ্য।

অনুজ বিশ্বাস, কৃষ্ণনগর, নদীয়া।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929